মানবদেহের ক্যান্সার নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। ক্যানসার খুবই জটিল একটি রোগ হওয়ায় বিশ্বব্যাপী ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে ।তবে ক্যান্সার হলে আর বাঁচা সম্ভব নয় , এ ধারণাও সঠিক নয়।
ক্যান্সার এর লক্ষণ বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ পায়। যেগুলো প্রথম পর্যায়ে দেখা দিলে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন ও ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। চলুন জেনে নেয়া যাক ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো যা আপনাকে ক্যান্সার সনাক্ত করতে সাহায্য করতে পারে।
০১.হঠাৎ ওজন বৃদ্ধি বা হ্রাস পাওয়া
কোনো কারণ ছাড়া আপনার হঠাৎ করেই যদি দ্রুতগতিতে ওজন কমে বা বেড়ে যেতে থাকে তবে তা চিন্তার বিষয়। কারণ, এটি ক্যান্সারের অন্যতম উপসর্গ হিসেবে চিহ্নিত। সেক্ষেত্রে আপনাকে অতিদ্রুত সচেতন হতে হবে. বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ি, এই উপসর্গ ৪০ শতাংশ (প্রায়) ক্যানসার রোগীর ক্ষেত্রে থাকে। তাই সতর্ক থাকা ছাড়া য়ার কোনো উপায় নেই।
০২.ত্বকে পরিবর্তন
অনেকেই ত্বকের ক্যান্সারের ব্যাপারে সচেতন নন। ত্বক হল শরীরের সবথেকে বড় অঙ্গ। এই অঙ্গটিতে অস্বাভাবিক পরিবর্তন ( শরীরে কোনও একটি জায়গা ফুলেছে, কিংবা অকারণে ঘটেছে ) ক্যান্সার শনাক্ত করার সহজ উপায়।তাই ত্বকে অতিরিক্ত তিল বা ফ্রিকেল অথবা আঁচিলের রং, আকারে অস্বাভাবিক পরিবর্তন যদি দেখা যায়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।এছাড়াও ত্বক লালচে হয়ে যাওয়া, ত্বকে ফস্কুড়ি পড়ে যাওয়া এবং রক্তক্ষরণও অন্যান্য ক্যান্সারের উপসর্গ।
০৩.দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি
আপনি যদি দীর্ঘ সময় ধরে ক্লান্তিবোধ করেন অথবা অবসাদে ভোগেন তবে সেটা অনেক রোগের কারণ হতে পারে । রক্তে বা মলাশয়ের ক্যান্সার হলে সাধারণত এ ধরনের উপসর্গ দেখা যায়। জন হপকিনস মেডিসিনস অনুযায়ি, এই ক্লান্তি আর সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি এক নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের গ্রহণকৃত খাবার শরীরে পুষ্টি যোগায়। কিন্তু ক্যানসার হলে শরীর পুষ্টি সংগ্রহ করতে চায় না। তাই, যদি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি ক্লান্তিবোধ করেন অথবা দীর্ঘসময় ধরে ক্লান্ত থাকেন, আপনার চিকিৎসাসেবা অবিলম্বে গ্রহন করা উচিত এবং ক্যান্সার এর লক্ষণ সম্পর্কে দ্রুত জানা উচিত আমাদের।
০৪.ঘন ঘন জ্বর
একজন মানুষের জ্বর, সর্দি হওয়া স্বাভাবিক। তবে অনেকসময় এই জ্বর শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়ার মাধ্যমে ক্যানসারের কারণ হতে পারে। এক্ষেত্রে বারবার জ্বর আসে। সেরে উঠাড় পর মাস খানেকের মধ্যেই আবার জ্বর আসে। এছাড়া কোনও ইনফেকশনের চিহ্ন ছাড়াই রাতের দিকে জ্বর আসা, রাতে ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যাওয়া ইত্যাদি হতে পারে এই রোগের লক্ষণ।দুর্ভাবনার ব্যাপার হলো, কিছু ক্যান্সারের শেষ পর্যায়েরই উপসর্গ হলো ঘন ঘন জ্বর আসা । তবে ব্ল্যাড ক্যান্সারসহ এ ধরনের আরো কিছু ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়েই ঘন ঘন জ্বর দেখা দেয় শরীরে। তাই অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি ।
০৫.অকারণে রক্তক্ষরণ
আপনার যদি কাশির সময় রক্তক্ষরণ হয়, তবে এটা ক্যান্সারের বড় লক্ষণ। এছাড়া স্ত্রী অঙ্গ (ভ্যাজাইনা) বা মলদ্বার থেকে রক্তক্ষরণসহ এ ধরনের অন্যান্য অস্বাভাবিকতাও ক্যান্সারের উপসর্গ। অকারণে রক্তক্ষরণ এ, ক্যান্সার এর লক্ষণ অনেকটা সাধারণ রক্তক্ষরণ এর মতোই হতে পারে, তাই আমাদেরকে সচেতন হতে হবে এসব ক্ষেত্রে এবং দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে ।
০৬.দীর্ঘদিনের ব্যথা
আপনি যদি দীর্ঘদিন ধরে শরীরের কোনো স্থানে ব্যথা অনুভব করেন,যার দৃশ্যত কোনো কারণ (যেমন জখম-আঘাত) নেই, ওষুধও কাজ করছেনা তাহলে এটা নিয়ে চিন্তার কারণ আছে। শরীরের কোণ জায়গায় ব্যথা সেটার উপর নির্ভর করছে রোগী ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত নাকি পায়ুপথ বা মলাশয়ের, ডিম্বাশয় ক্যান্সারে আক্রান্ত।তাই শরীরে দীর্ঘদিন কোনও ব্যথা দেখা দিলে অবশ্যই আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে। দীর্ঘদিনের ব্যথা ক্যান্সারের একটি লক্ষণ হতে পারে, তবে এটি সবসময় যে ক্যান্সারের চিহ্নিত লক্ষণ তা কিন্তু নয়।
০৭.অস্বাভাবিক মাংসপিণ্ড
আপনি যদি আপনার শরীরের কোনো অংশে অস্বাভাবিক কোনো ধরনের মাংসপিণ্ড দেখতে পান অথবা মাংস জমাট হতে দেখে থাকেন কিংবা এ ধরনের পরিবর্তন অনুভব করতে পারেন,তাহলে কখনো কখনো এ ধরনের পরিবর্তন মানব দেহে ক্যান্সারের অন্যতম উপসর্গ হতে পারে বলে মনে করা হয়ে থাকে। আর তাই আপনার শরীরে যে কোনো পরিবর্তন যদি সাধারণ দৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হয় তবুও পর্যবেক্ষণ করুন, এরপর অন্তত অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন আর সুস্থ থাকুন।
০৮.দীর্ঘস্থায়ী কাঁশি
আপনি যদি দেখেন যে ওষুধ খাবার পরও কোনো ভাবেই আপনার কাশি ভালো হচ্ছেনা অথবা কাশির কারণে বুক, পিঠ বা কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা তাহলে শীতকালীন কাশির চেয়েও এটাকে বেশি কিছু ধরে নিতে হবে এবং অতি দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
০৯.খাবার গ্রহণে সমস্যা
কেউ খাবার খেলেই যদি নিয়মিত বদহজমে ভোগেন, তবে পেট, কণ্ঠনালী বা গলার ক্যান্সার নিয়ে চিন্তার কারণ রয়েছে। অবশ্য সাধারণত এসব উপসর্গকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। তবুও অসুস্থতাকে কখনো এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়।
১০।মল-মূত্র ত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন (ক্যান্সার এর লক্ষণ-অন্যতম)
আপনি যদি ঘন ঘন মল-মূত্রের বেগ অনুভব করেন তাহলে ক্যান্সার নিয়ে ভাবনার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ঘন ঘন ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্যও মলাশয়ের ক্যান্সার এর লক্ষণ। মূত্রত্যাগের সময় রক্তক্ষরণ বা অন্ত্রে ব্যথা মূত্রথলির ক্যান্সারের অন্যতম উপসর্গ।
১১.অন্যান্য উপসর্গ
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপরে উল্লিখিত উপসর্গগুলোকে ক্যান্সারের সাধারণ লক্ষণ মনে করা হয়। তবে এর বাইরেও অনেক ক্যান্সার এর লক্ষণ আছে ।তার মধ্যে পা ফুলে যাওয়া, শরীরের আকারে বা অনুভূতিতে অস্বাভাবিক পরিবর্তন হওয়া ইত্যাদি।এই রোগের চিকিৎসা খুবই দ্রুত হওয়া প্রয়োজন। কারণ যত দ্রুত এই রোগের চিকিৎসা হবে ততটাই রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। এমনকী চিকিৎসার বিকল্পও বাড়বে।
তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন,প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার শনাক্ত করতে পারলে বেশিরভাগ ক্যান্সারেরই চিকিৎসা ও নিরাময় অনেক সহজতর হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ি, ক্যান্সারে এখন ৩০-৫০ শতাংশ মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই শরীরের যেকোনো অসুস্থতাকেই অবহেলা করা যাবেনা ,চিকিৎসাসেবা নিতে হবে। বিশেষ করে বয়স ৩০-৪০ বছর পেরিয়ে গেলে অবশ্যই প্রতি অর্ধবছর বা প্রতিবছর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত। তবে আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন,এই লক্ষণগুলি দেখা দিল মানেই যে ক্যানসার, তা কিন্তু নয়। তাই প্রথমেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
আরো পড়ুন-
কোলন ক্যান্সারের লক্ষণ