কোলন ক্যান্সার বিষয়টি সম্পর্কে এখন মোটামুটি সবাই জানে। কোলন হচ্ছে অন্ত্র, যা আমাদের খাদ্য পরিপাক এবং খাদ্যের নালিটির নিচের অংশ ।একে বলা হয় কোলন বা বৃহদন্ত্র। আর তারও নিচের অংশ যেখানে মল জমা থাকে সেটাকে বলা হয় রেক্টাম (Rectum)। এই অংশের ক্যান্সার-কে বলা হয় কোলোরেক্টাল বা কোলন ক্যান্সার । কোলন ক্যান্সারের লক্ষণ সম্পর্কে আমাদের জেনে রাখতে হবে যাতে করে এই বহুল প্রচলিত রোগটি থেকে বেচে থাকা যায় ।
০১.কোলন ক্যান্সারের লক্ষণ
প্রাথমিকভাবে কোলন ক্যান্সার নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন। কেননা কোলন ক্যান্সারের লক্ষণ অতি সহজে বোঝা যায় না। কোলন বা মলাশয়ের কোন জায়গায় ক্যান্সার রয়েছে তার উপর নির্ভর করে উপসর্গের বিভিন্নতা দেখা যায়। চলুন জেনে নেয়া যাক মানবদেহের কোলন ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সম্পর্কে-
১।হঠাৎ করে মল ত্যাগের প্রয়োজনের ব্যাপক তারতম্য অনুভূত হলে সেটা কোলন ক্যানসারের অন্যতম লক্ষণ।তখন পাকস্থলীর কার্যক্রমে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন ঘটে । যেমন রোগী সাধারণ সময়ের চেয়ে বেশি মলত্যাগ করে এবং মল অপেক্ষাকৃত তরল হয়ে থাকে।
২। হঠাৎ বমি বমি ভাব হওয়া,ওজন অনেক কমে যাওয়া ও গা গুলিয়ে ওঠা কোলন ক্যানসারের লক্ষণ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
৩। কোলন ক্যানসারের রোগীদের মল ত্যাগের সময় প্রচন্ড ব্যথা ও যন্ত্রণা অনুভূত হতে পারে। মলত্যাগের পরেও কখনো কখনো মল রয়ে যাওয়ার অনুভূতি দেখা যায়। সরু ফিতের মতো মল নির্গত হওয়াকেও কোলন ক্যানসারের উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
৪। পেট ব্যথা ,পেট ফাঁপা কোলন ক্যানসারের অন্যতম মুখ্য একটি উপসর্গ। আপনার যদি কোন জানা কারণ ছাড়াই পেটে ব্যাথা হয়, দূর না হয় বা খুব বেশি ব্যাথা হয় তাহলে এটাকে কোলন ক্যানসারের উপসর্গ মনে করা হয় । অনেক কিছুই পেটে ব্যথার কারণ হতে পারে, তবে আপনার অস্বাভাবিক বা ঘন ঘন পেটে ব্যথা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
৫। মলদ্বারে রক্তপাত হওয়া কোলন ক্যানসারের অন্যতম প্রধান লক্ষণ। অর্শ্বের সমস্যাতেও মলদ্বারের রক্তপাত হতে পারে। তবে এই ধরনের রক্তপাতের মধ্যেও রয়েছে তারতম্য। অর্শ্ব রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তপাত সাধারণত লাল হয় । কিন্তু কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এই রক্ত কালচে রঙের হয়ে থাকে। কালচে রং কে মানব দেহের অভ্যন্তর থেকে নির্গত রক্তের সূচক ধরা হয়।
৬। অন্ত্র থেকে রক্তপাত এর দরুণ, কোলন ক্যানসার রক্তাল্পতা তৈরি করে। আর এই রক্তাল্পতা ডেকে আনে ক্লান্তি। কখনো শ্বাসকষ্টও হতে পারে।
৭। অবস্থা যদি খুবই গুরুতর হয় তাহলে যেমন অতিরিক্ত ওজনশূন্যতা,কাশির সঙ্গে রক্ত পেটে পানি, পেটে চাকা, ইত্যাদি উপসর্গ প্রকাশ পাওয়া যায়।
৮। দুর্ভাগ্যবশত পূর্বে অপ-চিকিৎসার শিকার হওয়ার কারণে অনেক সময় রোগীদের রোগটির অতিমাত্রায় অগ্রসর অবস্থায় পাওয়া যায়।যা অনেক সময় নিরাময় অসম্কভব হয়ে পরে।তাই আমাদেরকে অবশ্যই সঠিক অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে ।
তবে আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, কোলন ক্যান্সারের লক্ষণ বুঝে ওঠা একটু কষ্ট সাপেক্ষ । কাজেই এই ধরনের যে কোনো উপসর্গ দেখা দিলেই যে কোলন ক্যান্সার হয়ে গিয়েছে তা কিন্তু সঠিক হিসেবে মনে করা ঠিক নয়, তাই আমাদের অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং সচেতন হতে হবে ।
০২.কোলন ক্যান্সার রোগ নির্ণয়
১। কোলন ক্যান্সার নির্ণয়ের প্রধান উপায় কোলন্সকোপি ও বায়োপসি। বায়োপসি’র মাধ্যমে ক্যান্সার নির্ণয়ের পর সিটি স্ক্যান করা, রক্তে এন্টিজেন (CEA) এর পরিমাণ নির্ণয় করা ইত্যাদি বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সারের ধাপ নির্ণয় (staging) করা হয়।
২। চিকিৎসার ক্ষেত্রে ধাপ নির্ণয় (staging) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক ধাপের (Stage I & II) ক্যান্সারগুলোর চিকিৎসা পরবর্তী ফলাফল সন্তোষজনক, অন্যদিকে অগ্রসর ধাপের (Stage III & IV) ক্যান্সারগুলোর চিকিৎসা পরবর্তী ফলাফল আশাপ্রদ হয়না।
৩। তাহলে তাকে অগ্রসর ধাপ বলে বিবেচনা করা হয় তখনি ,যখন ক্যান্সার কোলনের বাইরে ছড়িয়ে যায় (যকৃত, ফুসফুস ও লসিকাগ্রন্থি ইত্যাদি)
৪। তবে আশার কথা এই যে, অন্যান্য ক্যান্সারের চেয়ে কোলন ক্যান্সারের চিকিৎসা পরবর্তী ফলাফল অনেক ভালো হয়ে থাকে। এমনকি অগ্রসর ধাপের ক্যান্সার এ আক্রান্ত রোগী যদি সঠিক চিকিৎসা পায় তাহলে বহুদিন সন্তোষজনক ভাবে বেঁচে থাকতে পারেন। তাই কোলন ক্যান্সারের লক্ষণ আমাদেরকে আগে থেকেই জেনে রাখতে হবে।
০3.কোলন ক্যান্সারের চিকিৎসা
কোলন ক্যান্সারের চিকিৎসা মানেই এক কথায় অপারেশন। অপারেশনের আগে বা পরে কেমোথেরাপি দিতে হয়। অপারেশনের সময় রেডিওথেরাপির ব্যবহার করা যাবে কিনা এ নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে । ক্যান্সারের চিকিৎসায় সবচেয়ে বহুল প্রচলিত শব্দ হল (multidisciplinary approach), অর্থাৎ সার্জন, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ, প্যাথলজিস্ট,সাইকোথেরাপিস্ট ও ক্যান্সার কেয়ার নার্সসহ সকলের মিলিত প্রচেষ্টাই পারে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় করতে ।
০৪.কোলন ক্যান্সারের সচেতনতা
একটি বিষয় আমাদেরকে অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন যে, ক্যান্সার কঠিন রোগ হলেও এর উপযুক্ত চিকিৎসা রয়েছে বর্তমানে । রোগীদের সচেতনতা এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। অত্যাধুনিক চিকিৎসা থাকার পরও এই শতকেও মানুষ বাংলাদেশ এর মানুষ বিভিন্ন কবিরাজ,ঝার-ফুঁক,হাকিম এর উপর বিশ্বাস করছে।
চিকিৎসা ব্যয় সরকারী হাসপাতালগুলোতে অত্যন্ত কম। রোগীদের উচিত, যে কোনো রোগ সম্পর্কে পরিচিত জনের পরামর্শ না নিয়ে নূন্যতম এমবিবিএস চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া যাতে করে রোগ দ্রুত কমে যায় বা বাড়তে না পারে।
আপনার সচেতনতাই পারে রোগটিকে প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয়ে সাহায্য করতে। আর প্রথম দিকে ধরতে পারলে মনে করা হয় ক্যান্সারের মতো কঠিন রোগও সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব। কাজেই সচেতনতার পরিচয় দিয়ে আমরা সুস্থ থাকি।
আরো পড়ুন-
ক্যান্সার এর লক্ষণ